জিয়াউর রহমান মুকুল::
১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।এ বছর দিবসটি স্বভাবতই কিছুটা জৌলুশ হারিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে।বৈশ্বিক এই মহামারীতে শ্রমিকরা অধিকতর সমস্যা জর্জরিত।কেমন আছেন আমাদের প্রবাসী বন্ধুরা?করোনা পরবর্তী বিশ্বে তাদের অবস্থা কি হতে পারে।তা নিয়েই আজকের এই লেখা। পরিসংখ্যান মতে বর্তমানে বিশ্বের ১৬০ টি দেশে প্রায় এককোটি বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন। যার একটি বড় অংশ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা আরব বিশ্বে।
প্রবাসী বাংলাদেশী তাদেরকে বলা হয় যারা বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করার পর অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ভালো পরিবেশে বসবাস করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পরিবারকে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী করার আশায় বাংলাদেশীরা প্রবাসে পাড়ি জমায়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বসবাস, করে তাদের সংখ্যা প্রায় ১.২ মিলিয়ন। সৌদি আরব ছাড়াও আরব বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশে যেমন: সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার ও বাহরাইনে প্রচুর পরিমানের বাংলাদেশী প্রবাসী বসবাস করে। সেখানে বাংলাদেশীদেরকে বিদেশী কর্মী হিসেবে ধরা হয়।
মধ্য প্রাচ্য:সারাবিশ্বে যতজন প্রবাসী বাংলাদেশী বসবাস করে তাদের সিংহভাগই মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে। প্রায় ২৮ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশী মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে যাদের অর্ধেক সৌদি আরবে এবং চার ভাগের এক ভাগ আরব আমিরাতে বসবাস করে। বাংলাদেশীরা সাধারণত গৃহস্থালী কর্মী ও শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যায়।
সৌদি আরব:সৌদি আরবে ২০ লক্ষেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সৌদি আরবের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক যোগান দেয়। সৌদি আরবে ২০০৭ সালে ১৫ লক্ষ ভিসার মধ্যে প্রায় ২৩.৫০ শতাংশ ভিসা বাংলাদেশীদের দেওয়া হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করে।
কাতার: ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২,৮০,০০০ জনের বেশি বাংলাদেশী কাতারে বসবাস করে।
কুয়েত: জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৭ জন বাংলাদেশী গেছেন কুয়েতে। এর মধ্যে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের সুনাম বেড়ে যায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক দেশটিতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। ২০০৭ সালের শেষে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৮ সালে মাত্র ৩১৯ জন, ২০১০ সালে ৪৮ জন, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে মাত্র ২ জন ও ২০১৩ সালে ৬ জন কর্মী যান দেশটিতে।২০১৪ সালের শেষ দিক থেকে আবারও কর্মী যাওয়া শুরু করে। গত বছর ১৭ হাজার ৪৭২ জন কর্মী গেছেন দেশটিতে।জনশক্তি রফতানিকারকরা বলছেন, ২০০৫ সালেও ৪৭ হাজার কর্মী গেছেন দেশটিতে। বাজার পুরোপুরি চালু হলে বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হতে পারে।
ওমান: ওমানে বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৪.৬%। পরিসংখ্যান বলছে, ওমানের মাটিতে বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সুনামেও তারা সবার শীর্ষে। ফলে অন্য যেকোন দেশের শ্রমিকদের তুলনায় ওমানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের রয়েছে বিশেষ চাহিদা।সবশেষ ‘ন্যাশনাল সেন্টার অ্যান্ড ইনফরমেশন’ (এন সি এস আই) এর তথ্য মতে , ডিসেম্বর, ২০১৬ এর শেষের হিসাব অনুযায়ী ওমানে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ৬,৯৮,৮৮১। ভারতীয়রা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, তাদের সংখ্যা ৬,৮৯,৬০০ এবং ২,৩২,৪২৬ জন নিয়ে পাকিস্তানিরা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে এটি একটি বড় উদাহরণ হতে পারে। যেখানে অন্যান্য দেশে বাংলাদেশী কর্মীদের নিয়ে নানা নেতিবাচক ইমেজ বা ধারনা ছড়ানো হচ্ছে, সেখানে ওমানের প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিজেদের ইতিবাচক ভাবমুর্তিতে অটল। তারা অন্যান্য অভিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় বেশি পরিশ্রমী। আর এজন্য তারা যথেষ্ট মূল্যায়নও পাচ্ছে।জনশক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এনএসআই এর হিসাব অনুযায়ী ওমানে বেসরকারি খাতে ১৫,০৪,৯৩৬ জন, সরকারি খাতে ৬০,১৯৬ এবং গৃহকর্মী ও ড্রাইভার হিসেবে যাওয়া ২,৮৩,০৪৩ জনসহ মোট কর্মী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৮৪৮,১৭৫ এ।এদিকে, ওমানের সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারিতে মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪,৫৬,৮,০০৩ এ। যেখানে এনএসআইয়ের হিসেব মতে মোট প্রবাসীর সংখ্যা ২,০৯৪,৬১৬। অর্থ্যাৎ ওমানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.১ শতাংশই হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশী
পশ্চিমা বিশ্বঃ
যুক্তরাজ্য: ব্রিটিশ বাংলাদেশী সম্প্রদায় যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম অভিবাসী সম্প্রদায়। তারা প্রধানত ইস্ট লন্ডন, টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাস করে। এখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৩ শতাংশই বাংলাদেশী। জাতীয় আদম শুমারির তথ্যমতে প্রায় ৪০০,০০০ বাংলাদেশী ব্রিটেনে বসবাস করে যাদের ৯৫ ভাগই সিলেটি। লন্ডনের বাইরেও যেমন ম্যানচেস্টার, ওয়েস্ট মিনিস্টার ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমানে সিলেটি প্রবাসী বাংলাদেশী বসবাস করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: ২০০০ সালের আদম শুমারি মতে যুক্তরাষ্ট্রে পায় ৯৫,৩০০ জন বাংলাদেশী আছে। সুতরাং এটা অনুমান করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত দেড় লক্ষ বাংলাদেশী আছে।
১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশীরা প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শুরু করে। তারা নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ফিলাডেলফিয়া, এবং ওয়াশিংটন ডিসির প্যাটারসনের শহরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বাংলাদেশী, পাকিস্তানি ও ভারতীয়রা রেস্টুরেন্ট ব্যাবসার সাথে জড়িত। বাংলা নববর্ষের বৈশাখী মেলা নিউইয়র্ক, প্যাটারসন, ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি এবং অন্যান্য শহরে ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে প্রায় ১৩.৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রা বাংলাদেশে আসে।
ইতালি: বাংলাদেশীরা ইতালির বৃহত্তম অভিবাসী জনগোষ্ঠী। ২০০৫ সালের তথ্যমতে ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা ছিলেন প্রয় ১১৩,৮১১ জন। বাংলাদেশীদের অধিকাংশই নাপোলি, বোলোনিয়া, জেনোয়া ,রোম, মিলান ও ভেনিসে বসবাস করে।
বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।না পারছেন কোন কাজে যোগ দিতে না পারছেন স্বদেশে ফিরে আসতে।কারো অবস্থা হয়ত এমনও হয়ে থাকতে পারেন যার দরুন দেশে তার পরিবার পরিজনের সাথেও মোবাইলে কিংবা ইন্টারনেটে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন।তারপরও পরিবারের সদস্যদের দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে তারা হয়ত কপট হাসি হাসছেন।ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেওয়ার কথাও পত্রিকায় আসছে।যদি তাই হয় সহায় সম্বলহীন এইসব প্রবাসীরা উভয় সংকটে পড়বেন তাতে কোন সন্দেহ নেই ।একদিকে চাকরি হারাবেন অন্যদিকে দেশে রেখে যাওয়া পরিবারের দায়িত্বভার।সরকারিভাবে সেইসব দেশের সাথে যোগাযোগ করে বাংলাদেশী অভিবাসীদের চাকরি সুরক্ষিত করা যেতে পারে।যেহেতু করোনাভাইরাস বৈশ্বিক সমস্যা তাই সংশ্লিষ্টদেশসমূহ মানবিক দিক বিবেচনায় নিতেও পারেন।যদি কোন কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসেন তাহলে সরকারি সহযোগিতায় তাদেরকে পূনর্বাসনের সুব্যবস্থা করা যেতে পারে।প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককের পাশাপাশি সকল সরকারি অসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও বিনা সুদে রিহেবিলিটেশন লোন স্কিম চালু করা যেতে পারে।যেহেতু তারা নিজদের কস্টার্জিত রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছেন সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দূর্দিনের সারথি হয়ে তাদের কল্যাণে এগিয়ে আসতে পারেন। লক্ষাধীক নারী শ্রমিক বিদেশে কর্মরত রয়েছেন।তাদের স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করণে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।ইতিমধ্যে অভিবাসীরা করোনা আক্রান্ত হয়ে বিদেশের মাটিতে কিংবা দেশে এসে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারকে মৃত্যুজনিত এককালীন ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। আসন্ন ঈদ ও রমজান মাসে ব্যয়ভার বহনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের তালিকা প্রনয়ণ করে প্রত্যেকের বাড়িতে সরকারিভাবে শুভেচ্ছাসহ কিংবা শোকবার্তাসহ ঈদ উপহার পৌছানো যেতে পারে।রেমিট্যান্স প্রেরণের বিগত ১/২ মাসের রেকর্ড যাচাইপূর্বক সংশ্লিষ্ট প্রবাসীদের নিবাসী সদস্যদের মোবাইল একাউন্টে ভালোবাসাস্বরুপ নগদ অর্থ সহায়তা পাঠানো যেতে পারে।এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সংখ্যা যদি হয় ১ কোটি তাহলে তাদের আয়ের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল নিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হবে আনুমানিক পাঁচগুণ বেশি অর্থ্যাৎ মোট জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশ। প্রবাসীবন্ধুদের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া মানে হল বাংলাদের বর্তমান জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে মনে ভুলে যাওয়ার শামিল। চলমান বৈশ্বিক মহামারী পরবর্তী অনুমেয় মন্দা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে এদেশের কৃষকদের পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকদের পুনরায় রেমিট্যান্স যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাতে হবে।তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় তাদের প্রত্যেকের পরিবার সচল হলে অর্ধ বাংলাদেশ তাদের সোনালি দিনের দিশা পাবেন।ভাইরাস প্রাদূর্ভাবের কারণে আজকে আমাদের অধিকাংশ অভিবাসী বন্ধু চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন;তাদের হতাশার কাফনে স্বস্ব নিবাসী পরিবার পরিজনেরাও নিজকে অনেকটা একই কাফনে আবদ্ধ করছেন।ফলে তারাও বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যহানির শিকার হচ্ছেন।প্রবাসীদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসা দেখানো মানে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার উৎকৃষ্ট নজীর হয়ে থাকবে। তারাই বিদেশের মাটিতে এক একখন্ড বাংলাদেশ। প্রবাসীরা বাঁচলে বাঁচবে অর্থনীতি;বাঁচবে দেশ।অনুকম্পা নয় আসুন তাদের প্রতি যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করি।
পাঠকের মতামত